কয়েকদিন ধরে আমার খুবই আমাদের বাড়িতে বানানো কলির মায়ের হাতের চাপাতি আর সব্জী খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু রুটি বেলা তো দূরের কথা ডোটাই মাখাতে পারছিনা ভালো করে। সেদিন সিদ্দিকা কবিরের বই দেখে ডো করতে গিয়ে পুরাই ছেড়াবেড়া অবস্থা আর তারপর তো বেলুনটা এইদিকে চাপ দেই তো ঐ দিকে যায় ঐ দিকে চাপ দেই তো পিড়ি লাফ দিয়ে উঠে। আমার নাকানি চোবানি খাওয়া দেখে শুভ্র হাসতে হাসতে শেষ। মহাপন্ডিতি আর বিজ্ঞচালে এগিয়ে এসে বললো, আরে বোকা এভাবে না, আমি দেখাচ্ছি এই বলে পিড়ি বেলন টেনে নিয়ে সে যা বানালো! একটা তিনকোনা, একটা পাঁচকোনা আরেকটা রুটিতে একখানে মোটা আরেকখানে পাতলা হতে হতে তো ফুটাই হয়ে গেলো এত্ত বড়। তা দেখে হাসবো না কাঁদবো ভেবে ভেবে আর শুভ্রর বোকা বোকা মুখ দেখে মাথায় আবারও পাগলামী চেপে বসলো আমার। হাসতে হাসতে আমিও শেষ। বললাম এই ভাবে না? এই ভাবে বানায়! কত বড় পন্ডিৎ না?
ওর মাথায় এক মুঠো ময়দা ঢেলে দিয়ে ভূত সাজিয়ে দিয়ে দৌড় দিলাম ছাদের দিকে। আর এতেই শুভ্রের সম্বিৎ ফিরলো বুঝি। সেও ছুট লাগালো আরেক মুঠ ময়দা নিয়ে আমার পিছু পিছু। সারা ছাঁদ দৌড়ে, বিছানার উপর দিয়ে, টেবিলের পাশ দিয়ে ছুটে যখনই সিড়ির দিকে পালাতে নামছিলাম আর ওমনি শুভ্র আমাকে দু'হাতে ধরে ফেললো আর সেই মুহূর্তেই চোখে পড়ে গেলো সিড়ির মুখেই চোখ কটমটিয়ে, কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়িউলী মোটি খালাম্মা। পিছে আবার বাড়িওয়ালা খালু আব্বাও উঠে এসেছেন।
শুভ্রের সারা মাথায়, হাতে মুখে ওমন ময়দা মাখা ভূত সেজে থাকতে দেখে আর আমার মুখে, চোখে, গলা, কাঁধেও তার ছিটে ফোটা দেখে বাড়িউলী খালাম্মার বুঝতে বাকী রইলোনা বুঝি দুই দুইটা জ্যান্ত ভূতকেই তারা তাদের মহামূল্যবান চিলেকোঠাখানি ভাড়া দিয়েছেন। আমাদের এই অবস্থায় দেখে বাড়িওয়ালা নেমে গেলো। কিন্তু বদমাইস বাড়িউলী চোখ পাকিয়ে বললো,
- বলি হচ্ছেটা কি শুনি? এটা ভদ্রলোকের বাড়ি তো, নাকি? এই দিন দুপুরে যদি এই ধাড়ি ধাড়ি মানুষগুলো তোমরা এমন হুটাপাটা করে ছুটোছুটি বাড়ির মধ্যে সিনামাহল বানায় তোলো তাইলে বাড়িতে তো আরো ছেলেমেয়েরা আছে নাকি? তাদের আদব কায়দার কি হাল হবে বুঝতে পারছো? আমাদের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সাহস বুঝি আরও বেড়ে গেলো। আরও এক ধাঁপ গলা চড়িয়ে বললেন,
- ভালো করে শুনে রাখো বাছারা। আমার বাড়িতে এই সব সিনেমা নাটক চলবে না। ভদ্র সভ্য হয়ে থাকতে পারো তো থাকবে, নাইলে বাবা মানে মানে কেটে পড়ো। আমার ঘরভাড়ার অভাব হবে না। গট গট করে চলে গেলেন উনি। আমার রাগ তো লাগলোই না বরং তার কথা শুনে ও হাঁটার স্টাইল দেখে আমরা দুজনই হাসিতে ফেটে পড়লাম। তবে ডিসিশন নিলাম খুব শিঘ্রিই আমরা এই চিলেকোঠা ছেড়ে উঠে যাবো ছোট খাটো কোনো ভদ্রস্থ ফ্লাট খুঁজে। যেখানে হবে আমাদের সুখের নীড়। নিরুপদ্রব জীবন। এরপর আমরা বাড়িউলীর কথা তোয়াক্কা না করে আবারও ছুট লাগালাম ছাঁদের দিকে। কল তলার থেকে এক বালতি পানি নিয়ে শুভ্র আচমকা আমার মাথায় ঢেলে দিলো। আমিও কি ছেড়ে দেবো! আমিও আরেকটা বালতির অভাবে মগ দিয়েই ড্রামে জমিয়ে রাখা পানি থেকে পানি তুলে ছুঁড়ে মারলাম ওর দিকে। তার পরপরই চোখে পড়ে গেলো টবে পানি দেবার হোসপাইপটা। সাথে সাথে সেটা দিয়ে ওকে ভেজা কাক বানিয়ে দিতে মোটেও দেরী করলাম না। এভাবেই হাসি আনন্দ আর আবোল তাবোল পাগলামীতে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো।
বরং শুভ্রের কাছে চলে আসার পর হতেই অফিসটাই আমার কাছে দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে। এই কাজ পাগলার আমির অফিসের কাজে কামে একেবারেই আর মন নেই যেন। সারাক্ষন আমার মন পড়ে থাকে ওই এক চিলতে চিলেকোঠার এবড়োখেবড়ো চেহারার মাঝে নিজের হাতে ফুটিয়ে তোলা এক রতি স্বর্গের জীবনে। ওখানে আমার শুভ্র আছে। আর আমাকে রোজ তাকে ছেড়ে চলে আসতে হয় অফিসে। ব্যপারটা আমার মোটেও পছন্দ না। শুভ্র ঘুমিয়ে আছে। ওর ঘুম মুখ মনে পড়ে। এখন কি উঠলো? কি খেলো? কি করছে? এসব ভাবনায় আনমনা হয়ে পড়ি মাঝে মাঝেই।
অফিসের নাজমা আপা তো সেদিন হাতে নাতে ধরেই ফেলেছিলো। গালে হাত দিয়ে আমি হা করে বসে বসে ভাবছিলাম যখন গত রাত্রীর শুভ্রর লেখা কবিতাটার কথা। আর তাই নিয়ে আমার সন্দেহ করে রাগের ভূত হয়ে যাবার কথাটাও। মানে কাল হঠাৎ শুভ্রের পুরানো কাগজ পত্রের ড্রয়ারটা গুছাতে গিয়ে হঠাৎ দেখি এক প্রেমের কবিতা। একটা খাতার পিছে ওর নিজের হাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছে।
তোমার কপালে এঁকেছিলাম
লাল টিপ ভালোবাসা,
বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় ঘোরলাগা ক্ষনে,
তোমার কপালেই এঁকেছিলাম
প্রথম চুম্বন.....
প্রথম চুম্বন! এতটুকু পড়েই আমার মাথা ঘুরে গেলো? তবে কি শুভ্রর আগেও কোনো প্রেম ছিলো? কে সেই মেয়ে? কেনো শুভ্র আমাকে বলেনি তার কথা? কেনো শুভ্র আমাকে ঠকালো! এত সব কেনো , কে, কি এর সমারোহে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। শুভ্র তখন সূচীশভ্র বিছানায় বসে এক মনে গভীর মনোযোগে ল্যাপটপে কোনো কাজ করছিলো বুঝি। আমি হঠাৎ রাগে দুঃখে ফুলে ফেঁপে উঠে ফোস ফোস করে কুচি কুচী করে ওর খাতা ছিঁড়তে লাগলাম। আমার মুখ মনে হয় রাগে উন্মাদিনীর মতই হয়ে উঠেছিলো। আমার কান্ডে চমকে গেলো শুভ্র। তাড়াতাড়ি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কি হয়েছে তোমার! এমন করছো কেনো? আমি সেসব পাত্তা না দিয়ে বললাম কি হয়েছে মানে? জানোনা না? সাধু বাবা আসছো? শুভ্র ভীষন ভয় পেয়ে বললো, সাধু বাবা? সাধু বাবা আবার কি? আমি হাতে ধরা খাতার কুঁচি কুঁচি টুকরোগুলো দেখিয়ে বললাম। কে ছিলো মেয়েটা? এখনই বলো। আমি রাগে কাগজের টুকরাগুলো ওর গায়ে ছুড়ে মেরে ওর গলাই চেপে ধরলাম।
শুভ্র মনে হয় নিজেই ভুলে গেছিলো ঐ খাতায় কবে কি লিখেছিলো। সে আমার গলা চাপা খেয়ে কাঁশতে শুরু করলো। আর তখনই আমার জ্ঞান ফিরলো। তাড়াতাড়ি ওকে চেয়ারে বসিয়ে পানি নিয়ে এলাম। পানি খেয়ে শুভ্র বললো, কি হয়েছে বলো, না জেনেই খুন করে ফেললে তো লাভ নাই তাই না? কখনও জানাই হবেনা কি কারণে এত খেপলা তুমি। সেই কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গেলো। শুভ্র আমার চোখে তখন এক বিরাট প্রতারক। অনেক কষ্টে সৃষ্টে শুভ্র শেষ পর্যন্ত যখন জানতে পেলো ঐ কবিতা নিয়ে আমার এই রাগের কথা। তখন সে হাসতে হাসতে সব খুলে বললো কেনো ঐ কবিতা লিখেছিলো এবং ঐ কবিতার সাথে সত্যিকারের কোন মানবীর সম্পর্কই নেই।
এই সব সুখ দুঃখ হাসি কান্না আনন্দ বেদনার মাঝেও জীবনের এক অপার মধুসূধা পান করে চলেছিলাম আমরা। খুব অবাক লাগে। এত কিছুর মাঝেও জীবনের এত সুখ মিশে থাকবে বুঝতে পারিনি আগে। এ মাসের শেষে শুভ্রর ফাইনাল এক্সামের কি একটা প্রেজেন্টেশন আছে। তারপর কক্সেসবাজার যাবো বলে ঠিক করেছি আমরা। আমার জমানোর টাকার সবটাই তাই খরচ করিনি এখনও। সাথে ওর বাড়িতেও ঘুরে আসবো একবার। ওদের বাড়িতে কেউ এখনও জানেইনা আমাদের এই বিয়েটার কথা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:০১